ইয়াহিয়া নয়নঃ- মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অবস্থিত আরাকানের উত্তরে মিয়ানমারের চিন স্টেট, ম্যাগওয়ে রিজিয়ন, বাগো রিজিয়ন, পূর্বে ইরাবতি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থিত। মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক শাখা আরাকানকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই করছে। রাখাইনরা থেরোবাদী বৌদ্ধ মগ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে তারা আলাদা। মিয়ানমার ১৭৮৪ সাল থেকে জোরপূর্বক আরাকানকে দখল করে রেখেছে এবং তারা ঔপনিবেশিক শক্তি। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকানের রাখাইনরা লড়াই করলেও দু’পক্ষের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। তা হলো- দুই পক্ষের কেউই রোহিঙ্গাদের আরাকানের মূল জাতিসত্তার অংশ মনে করে না।
আরাকানি বৌদ্ধ রাখাইন মগদের হাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। ২০১২ সালের দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল তারাই। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার না পেতে পারে, সে জন্য তারা জোরালো আন্দোলন করে আসছে দশকের পর দশক। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিচয়কে ঘিরে আরাকানের রাজনীতি ও সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবর্তিত হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়; আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানি মুসলমানের বংশধর।
আরাকান আর্মি আরাকানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হলেও এদের ক্যাডারদের অবস্থান মুখ্যত কাচিন এলাকায়। সেখানে লাইজা অঞ্চলে তাদের সদর দপ্তর। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামনে শক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে গোষ্ঠীটি। রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলেই শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে তাদের। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে নিজেদের অভয়রাজ্য গড়ে তুলেছে। অনেক এলাকায় গড়ে তুলেছে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। তবে প্রধান সংঘর্ষস্থল হলো চিন স্টেটের পালিতওয়া। বান্দরবান সন্নিহিত কালাদন নদীর পাড়ের এই স্থান বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত।
২০০৯ সালে তরুণ ছাত্রনেতা তোয়ান ম্রেট নায়েংয়ের নেতৃত্বে মাত্র ২৯ জন নিয়ে গড়ে ওঠা আরাকান আর্মি দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর মাঝে রয়েছে তাদের বেশ জনপ্রিয়তা। বর্তমানে তাদের ১০ হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক উইং ‘ইউনাইটেড লীগ ফর আরাকান’ (ইউএলএ)। উল্লেখ্য, আরাকান আর্মি হলো মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের অপর গেরিলা গ্রুপ ‘আরাকান লিবারেশন আর্মি’ বা ‘এএলএ’র থেকে পৃথক একটি সংগঠন। এএলএ হলো আরাকানের সবচেয়ে প্রাচীন গেরিলা দল। বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতি চলছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনাভিযানে এএলএর ভূমিকা ছিল সহায়কের।
ভূকৌশলগত কারণেও রাখাইন রাজ্যটি বর্তমানে প্রতিবেশী চীন-ভারত ও বহির্বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের রয়েছে বিরাট রাজনৈতিক প্রভাব ও বিনিয়োগ। চীন রাখাইনের কিউকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, সিনো-মিয়ানমার তেল-গ্যাস পাইপলাইন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। চীন মালাক্কার ঝুঁকিপূর্ণ প্রণালি পরিহার করে বিকল্প জ্বালানি রোড হিসেবে বেছে নেয় রাখাইন উপকূলের কিউকফিউ থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প। এই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পথেএগিয়ে চলেছে। তারপরেও দেশ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক বেশ কৌশলী ও জটিল।
চীন বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদী এথনিক সশস্ত্র গোষ্ঠীদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বৃহৎ এথনিক আর্মি দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি, আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মিসহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন চীনের কাছ থেকে অর্থ, অস্ত্র ও আশ্রয় পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এথনিক আর্মিদের চীন আসলে মিয়ানমারের সঙ্গে ‘বার্গেইনিং চিপ’ হিসেবে ব্যবহার করে। তাই, মিয়ানমার চীনের এই কৌশল মোকাবিলায় ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
যখন মিয়ানমারের সরকার এককভাবে চীনা নির্ভরতা থেকে কিছুটা বের হয়ে বহুপক্ষীয় নির্ভরতার সুযোগ গ্রহণ করে। তখন ভারতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে বৃহত্তর আসামের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ তৈরি। এ জন্য মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের সিটওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের পালেতোয়া হয়ে মেঘালয়ের আইজল পর্যন্ত সরাসরি সংযোগের জন্য কালানদান রিভার প্রকল্প গ্রহণ করে। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সে কারণে ভারত লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর। ৬০ কিলোমিটার লম্বা ও ২২ কিলোমিটার প্রস্থের সরু এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাদল শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ভারতের জন্য অবশ্যই এসব চিন্তার বিষয়।
নিরাপত্তার জন্য তাই ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প পথ তৈরি করছে। কালাদান মাল্টি মডেল ট্রানজিট প্রকল্পটি মূলত কলকাতা হলদিয়া বন্দর থেকে আরাকানের সিতওয়ে বন্দর পর্যন্ত ৫৩৯ কিলোমিটার সমুদ্র পথ। সিতওয়ে বন্দর থেকে কালাদান নদী বেয়ে মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর পর্যন্ত ১৫৮ কিলোমিটার নৌপথ পথ। সেখান থেকে মিজোরাম রাজ্যের আইজাওয়াল পর্যন্ত ১৯৭ কিলোমিটার সড়ক পথ। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে কলকাতা থেকে আইজাওয়াল পৌঁছাতে মাত্র ৮৯৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। বর্তমানে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে মিজোরামের আইজাল শহরে পৌঁছাতে ১৮৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আরাকানের পরিবেশ শান্ত থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে। ভারত ও চীন উভয়েই রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারতের অতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও কোনো দেশই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অধিকন্তু, বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশ হয় সরাসরি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোটদানে বিরত থেকেছে।
২০১৮-১৯ সালে মিয়ানমার সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সেনারা মিজোরামে আরাকান আর্মির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে সব ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। তার প্রতিদান হিসেবে মিয়ানমারের সেনারা সাগাইং প্রদেশে ভারতের নাগা, মিজো ও আসামিয়া বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ চালায়। আরাকান আর্মি ২০১৯ সালের নভেম্বরে কালাদান প্রকল্পের ৫ জন ভারতীয় কর্মীকে অপহরণ করে এবং ভারতকে জানিয়ে দেয়, আরাকানে কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের কর দিতে হবে। কিন্তু কিয়াকফিউতে চীনের কোনো কাজে তারা বাধা দেয় না, তারা বলে, ‘চীন আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে, ভারত দেয়নি।’
সবশেষে একথা বলতেই হয় যে, আরাকানের এই সংঘাতের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই বলে আসছেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকির কথা। বিচ্ছিন্নতাবাদী,ধর্মান্ধ-জঙ্গিগোষ্ঠির কথা। তার আশঙ্কা আজ বাস্তবে প্রকাশ পাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক।