নাসির উদ্দিন ফকির, বেতাগী ॥ কর্মচাঞ্চল্য তরুণ মেধাবী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমানের বাড়ীতে এখন চলছে শোকের মাতম। সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিল। সবশেষে গত বৃহস্পতিবার বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জানিয়েছিলেন, আটকে থাকা জাহাজ ছাড়া পেলে শীঘ্রই বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু গত বুধবার (০৩ মার্চ) ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ গোলার হামলার শিকার হয়েছে। ওই দিন স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে এ হামলা হয়। এতে জাহাজে আগুন ধরে নিহত হন হাদিসুর রহমান (২৯)। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ছেলের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন হাদিসুরের মা-বাবা। শোকে মুহ্যমান পরিবারের অন্য স্বজনেরাও। বাড়িতে এখন শুধুই শোকের মাতম। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা খবরটা জানতে পারেন। হাদিসুরের মৃত্যুর খবরে এলাকার মানুষের মধ্যেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। খুব সকাল থেকেই এখবরে তার বাড়িতে ভীড় জমাতে শুরু করে মানুষ। হাদিসুর রহমান বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। চার ভাই বোনের মধ্যে হাদিস মেঝো। হাদিস সম্পর্কে বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান তার চাচাতো ভাই। বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘হাদিস ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলো। সে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পাস করার পর ২০১৮ সাল থেকে ওই জাহাজে ছিল। অবিবাহিত ছেলেটা সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিল মাস ছয় আগে। হাদিসের স্বজনরা জানান, আট বছর ধরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিভিন্ন জাহাজে চাকরি করেন হাদিসুর। বুধবার জাহাজ থেকে ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স ফোন করেন হাসিদ। তবে বিকট শব্দের কারণে কিছুই শুনতে পারেননি তিনি। এর মধ্যে হাদিসুর জাহাজের সামনে বাইরে অবস্থান করায় রকেট হামলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিহত হয়েছেন। হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স বলেন, গোলার আঘাত হানার সময় বড় ভাই বাইরে এসে মুঠোফোনে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। তবে কথার এক পর্যায় হঠাৎ করে একটি গোলা এসে পড়ে জাহাজটিতে। বিকট শব্দের পর আর কিছুই শুনতে পাইনি এবং কোন কথা হয়নি। হাদিসুর রহমানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন,‘ বাড়িতে এসে ছেলের ঘরের কাজ ধরার কথা ছিল, ছিল বিয়ের কথাও। এখন সব কিছুই শেষ। আমি সন্তানের লাশ দেখতে চাই। মা আমেনা বেগম বাকরুদ্ধ। কথা বলতেই সে বারং বার মুর্ছা খাচ্ছে আর বুক থাপরাচ্ছে। বলতে গিয়েও কিছুই বলতে পারছে না। হাদীসের চাচাতো ভাই জসিম উদ্দীন বলেন, হাদীস খুব ভাল ছেলে ছিলো। বাড়ীতে আসলে সে সকল আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নিতো। তাকে আমার কখনো ভুলতে পারেবোন। জানা যায়, বাংলাদেশের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি গত ২৪ ফ্রেরুয়ারি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে পৌঁছায়। ওই দিনই দেশটিতে রাশিয়ার হামলা শুরু হলে বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে জাহাজে আটকা পড়েন ক্যাপ্টেন জি এম নুর-ই- আলম, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুকসহ ২৯ বাংলাদেশি নাবিক। ইউক্রেনে হামলা শুরুর সপ্তম দিনে বাংলাদেশি জাহাজটিতে গোলার আঘাতের ঘটনা ঘটল। সমুদ্রগামী জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি ২০১৮ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়। নিহত হাদিসের বাড়িতে আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনঃ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় নিহত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাসিদুর রহমান আরিফের গ্রামের বাড়ি পরিদর্শনে আসেন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫ টায় তিনি হাদিসের বাড়িতে আসেন। এসময় তিনি হাদিসের শোকার্ত পিতা মাতাকে শান্তনা দেন এবং লাশ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। আফজাল হোসেন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে নৌ পরিবহন মন্ত্রীকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিন। হাদিসের লাশটি দেশে আনা এবং সেখানে আটকে থাকাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। আমরা আশাবাদী লাশটি চলে আসবে এবং সেখানে যারা আটকা রয়েছে তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনা হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বরগুনা-২ আসনের সাংসদ শওকত হাচানুর রহমান রিমন, জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু, বেতাগী উপজেলা চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান ও বেতাগী পৌর সভার মেয়র এবিএম গোলাম কবির ও বরগুনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনিরসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। বরগুনা-২ আসনের সাংসদ শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, আওয়ামীলীগ সরকার সবসময় গরীবের পাশে থাকে। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাদিসের পরিবারের পাশে থাকবেন। রাশিয়ান দূতাবাসের শোকঃ ইউক্রেনে বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় নাবিক হাদিসুর রহমান আরিফের (২৯) মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে ঢাকায় অবস্থিত রুশ দূতাবাস। বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) এক বিবৃতিতে এ সমবেদনা জানানো হয়। যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ রুশ বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল বলে ইউক্রেনের গণমাধ্যমে খবর এলেও রাশিয়া বিষয়টি স্বীকার কিংবা অস্বীকার না করেই বলেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ইউক্রেনে বাংলার সমৃদ্ধি” জাহাজের প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান আরিফ রকেট হামলায় নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনার ’সার্বিক পরিস্থিতি’ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা প্রয়াতের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। বন্দর থেকে বাংলাদেশি জাহাজের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিতে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ‘রাশিয়ান ফেডারেশনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড বিশ্বাসযোগ্য ডেটা পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে বারবার বলেছে, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পিছু হটার সময় নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে জিম্মিদের ধরে নিয়ে যায়, তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এটা সন্ত্রাসীদের সুপরিচিত একটি কৌশল। দূতাবাস জানায়, ইউক্রেনের বিশেষ সামরিক অভিযান থেকে উদ্ভূত মানবিক সমস্যা সমাধানে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হটলাইন চালু করেছে। হটলাইন নম্বর +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৩৪-৪৬, +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৪২-১১ ও +৭ ৪৯৫ ৪৯৮-৪৭-০৯। এ ছাড়া ইমেইলে (মঁসাং@সরষ.ৎঁ) যোগাযোগের অনুরোধ করা হয়েছে। হাদিসুরের মরদেহ জাহাজেই সংরক্ষণ করা হয়েছেঃ নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজে রকেট হামলায় নিহত হাদিসুরের মরদেহ জাহাজেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া জীবিত ক্রুদের কবে ফিরিয়ে আনা হবে সেটা যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। বুধবার (২ মার্চ) স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায়) বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে রকেট হামলা হয়। এতে হাদিসুর মারা যান। হাদিসুর ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হাদিসুরের মরদেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু সে সরাসরি আক্রান্ত হয়েছিল তাই অনেকেই ধারণা করেছেন তার দেহ পুড়ে গেছে। হ্যাঁ, শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। কিন্তু হাদিসুর আমাদের সংরক্ষণে আছে। আমরা তাকে সংরক্ষণ করতে পেরেছি। এটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। হাদিসুরের মরদেহ কবে নাগাদ বাংলাদেশে আসতে পারে? জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা তো বলা মুশকিল। আমরা হাদিসুরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমিই কথা বলেছি। যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে হাদিসুরকে কবে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারবো। ওই স্থানের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। তিনি বলেন, দুই পক্ষের কথা বার্তার মধ্যে ভালো কিছু দেখছি না। যদি ভালো হয়ে যায় তাহলে নিশ্চিতভাবে আমরা হাদিসুর ও বাকিদের নিরাপদে দেশে নিয়ে আসতে পারবো।