গৌরনদী প্রতিনিধি ॥ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দক্ষিণ সাকোকাঠী গ্রামের জেলেপল্লির অর্ধশত পরিবারের নারীরা তৈরি করছেন শটির পালো। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও পালো তৈরির কাজটি টিকিয়ে রেখেছেন তারা। জানা গেছে, বছরে তারা প্রায় ৭০০ কেজি পালো উৎপাদন করছেন। দিনদিন পালোর চাহিদাও বাড়ছে। তাই পালো নিয়ে তাদের স্বপ্ন অনেক। কবিরাজি মতে, শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি ভেষজ খাবার পালো। মানব দেহের বিভিন্ন জটিল রোগ সারাতে প্রাচীন কাল থেকে লোকজ চিকিৎসায় শটির পালোর ব্যবহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পালো একটি পুষ্টিকর (দেখতে ময়দার ন্যায়) ভেষজ খাবার। সময়ের বিবর্তনে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী পালো এখন বিলুপ্ত প্রায়। খবর নিয়ে জানা গেছে, পালো তৈরির প্রথম কারিগর হলেন জেলেপল্লির বাসিন্দা মিনতি রানী দাস (৮০)। তিনিই প্রথম পালো তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। তার হাত ধরেই এক-এক করে পল্লির প্রায় ৫০ জন নারী বাড়িতে বসেই সংসারের কাজের ফাঁকে শটির পালো তৈরি করছেন। পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ ঘরে বসে বাড়তি আয় করে অভাবের সংসারে একটু আর্থিক জোগানও দিচ্ছেন তারা। শটি প্রাচীনকাল থেকে মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত একটি ভেষজ উদ্ভিদ। এ গাছের কন্দ থেকে তৈরি হয় পালো। দেশে এলাকা ভেদে শটি, হডি, সাদা হলুদ, বনফুলসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। মূল্যবান এই ভেজষটি সমতল জমির পাশে কিংবা রাস্তার পাশে কোনো পরিচর্যা ছাড়াই জন্মে থাকে। এর কন্দ সংগ্রহ করে পালো তৈরি করা হয়। দক্ষিণ সাকোকাঠী জেলেপল্লির কনক রানী দাস (৫৫), অঞ্জলী রানী দাস (৬০), জয়ন্তী রানী দাস (৩৫) বলেন, মাঘ-ফাল্গুন মাসে বিভিন্নভাবে শটির কন্দ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে ছোট টিনের টুকরা ছিদ্র করে তার উপরে ঘষে কন্দগুলোকে ঘষে কুঁচি কুঁচি করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় ১২ ঘণ্টা। এরপর ধুয়ে ওপর থেকে পানিসহ ময়লা ফেলে দিলে নিচে ময়দার মতো পালো জমা হয়; এটি একইভাবে ৫-৬ বার ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হয়। তারা জানান, ১৫ থেকে ২০ কেজি কাঁচা শটির কন্দে এক কেজি খাওয়ার উপযোগী পালো তৈরি হয়। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি এই পালো স্বাভাবিক আবহাওয়ায় ২-৩ বছরেও নষ্ট হয় না। তাদের উৎপাদিত পালো প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। জেলেপল্লির বাসিন্দা এবং পালো সরবরাহকারী নিতাই দাস (৬০) বলেন, আমাদের জেলেপল্লি এখন পালো পল্লি নামেও অনেকে চিনে। আমরা প্রতিকেজি পালো ৬০০ টাকা পাইকারি বিক্রি করি। বাজারে প্রচুর চাহিদা আছে পালোর কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমরা সরবরাহ করতে পারছি না। পালো তৈরি করতে শটির প্রয়োজন, শটি কম হওয়ায় পালোও কম হচ্ছে। বছরের ১২ মাস যাতে পালো তৈরি করা যায় সে চেষ্টাও আমরা চালাচ্ছি। বর্তমানে ৩ মাস আমাদের এ পল্লির প্রতি ঘরেই পালো তৈরি হয়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, শটির পালোর উপকারিতা স্বাস্থ্যের জগতে আলোচিত আকর্ষণীয়। জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ ও ব্যথা দূর করে শরীর থেকে টক্সিন অপসারণ করে, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন চর্মরোগের জন্য একটি কার্যকর প্রাকৃতিক প্রতিকার। এটি অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল হিসেবে কাজ করে। পালো সেবনে পাকস্থলীর স্বাস্থ্য ও হজম শক্তি ঠিক রাখে। এছাড়াও ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং এবং অন্যান্য কারণে হজমের সমস্যাগুলো নিরাময় করে। আলসার প্রতিরোধ করতে পারে। শিশুদের জন্যও এটি একটি আদর্শ খাবার।